দৈনিক ইত্তেফাকে সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখের লেখা পড়ে মনে হলো, সামরিক বাহিনী সত্যি সত্যি ছায়ার সাথে যুদ্ধ শুরু করেছে। সাবধান করে দেয়া হচ্ছে অনেককে। মার্কিন মুল্লুকে বাংলাদেশ সরকারী গোয়েন্দা পাঠিয়েছে। বিদেশে প্রবাসী কারা সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে পাঁয়তারা করছে তাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য। সামরিক সরকারের মুখপাত্র মঈনুল হোসেনের পত্রিকা ইত্তেফাক ছাপিয়েছে এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি:
"এই বিশেষ মিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশের একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তিন কর্মকর্তা এরই মধ্যে নিউইয়র্কে এসে পৌঁছেছেন। গোয়েন্দারা বৈধ-অবৈধ নির্বিশেষে পেশাজীবী, রাজনীতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করছেন এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে আন্দোলনকারীদের নাম-ধাম এমনিক অভিবাসন মর্যাদা পর্যন্ত সংগ্রহ করছেন। ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায় যে, প্রাবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজনকে গোয়েন্দাদের সনাক্ত করা তেমন কোন কঠিন কাজ নয়। আন্দোলনকারীদের পুরো তথ্য-উপাত্ত, দেশের বিমান বন্দর ও নিজনিজ এলাকার থানাগুলোতে পাঠানো হবে। সূত্রটি আরো জানায় যে, জন্মসূত্রে বাংলাদেশী অথচ মার্কিন পাসপোর্টধারী কোন আন্দোলনকারীই যাতে নিস্তার না পায় সে লক্ষ্যে তাদের প্রতিকৃতি ও ভিডিও ফুটেজ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সরবরাহ করা হবে। এছাড়া প্রবাস থেকে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার নামে যারা কোন প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়া দেশের পত্র-পত্রিকায় ভিত্তিহীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ পরিবেশন করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে তাদের নাড়ী নক্ষত্রেরও খোঁজ নেয়া হচ্ছে..."।না, ইত্তেফাককে বাহবা দেওয়ার কিছু নেই। ক্যান্টনমেন্টের দোর্দন্ড প্রতাপের এই সময়ে তারা যে দু:সাহস দেখাননি, তা কি মুখ ফুটে বলতে হবে? যেমন খসড়া দেয়া হয়েছে, তেমনটা লেখা হয়েছে পত্রিকার পাতায়। এধরণের প্রতিবেদন দিয়ে সরকার কাকে ভয় দেখাতে চায়? যারা হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাত করেছে তাদেরকে, না যারা গণতন্ত্র ও নির্বাচিত সরকারের প্রত্যাবর্তন দেখতে চায় তাদেরকে? প্রতিবেদনটি ইংরেজী পত্রিকায় উঠেনি। উঠলে ভাল হতো। তবে ইত্তেফাকে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি যে হয়রানি করার আর চোখ রাঙ্গানোর অশনি ও অশুভ সংকেত তা কি বলার দরকার আছে? বড়োই দুর্ভাগা জাতি। বারবার এখানে জনগণকে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়। তাতে অশুভ শক্তি পিছু হটে, রং আর ভোল পাল্টায়। ট্রাক থেকে সহাস্যে গোলাপ ফুলের শুভেচ্ছা নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যায়। নব্বইয়ের এপিসোড আবারও কি দেখা যাবে আঠারো বছর পরে?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্দেশ্য সৎ ছিল। নিরপেক্ষ নির্বাচন আর দুর্নীতির বিরোধী কার্যক্রম শেষাবধি নতুন রাজনৈতিক দল তৈরীর ফন্দিবাজিতে গিয়ে ঠেকল। এধরণের ধান্ধাবাজির কি কোন দরকার ছিল? নতুন পদলেহীরা সহাস্যে রাজনীতির দাবার ঘুঁটি চালছে। তবে জনগণ যে ক্রমশ:ই বুঝতে পারছে সামরিক বাহিনীর ধান্ধা কি? সব দূর্নীতির হিসেব বেরোচ্ছে, সামরিক বাহিনীতে ডিফেন্স পার্চেজের দূর্নীতির শ্বেতপত্র কি বের হবে? তারা কি ধোয়া তুলসী পাতা? হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যায়, তার খবর কে রাখে? নির্বাচন কমিশনের অন্যতম সদস্য একজন অব: জেনারেল পার্বত্য এলাকার জন্য বরাদ্দ গম লোপাট করে বাধ্যতামূলক অবসরে গিয়েছিলেন, সেই কথা অনেকেরই অজানা না। ছোট উদাহরণ। দরিদ্র বাংলাদেশের দু লক্ষ সামরিক সদস্যের জন্য বিলাস বহুল চোখ ধাঁধানো ক্যান্টনমেন্ট তৈরী না করে ১৫ কোটি মানুষকে এই ক্যান্টনমেন্টের বাসিন্দা করার দরকার। চলমান সংস্কারের জোয়ারে সামরিক বাহিনী কেন বাদ পড়বে? বের হোক শ্বেতপত্র সামরিক বাহিনীর পেছনে ব্যয় বরাদ্দ কতো? এর বাইরে বেসামরিক বাজেট থেকে কতোটা লুটেপুটে নেওয়া হয়? ডিফেন্স বাজেটের নামে কতোটা লুটপাট হয়? বাংলাদেশ কার সাথে যুদ্ধ করবে? নিজের ছায়ার সাথে? এখন যুদ্ধ শুরু হয়েছে নিজের ছায়ার সাথে।
জনগণের শক্তি কখনও বন্দুকের নলের কাছে হার মানে না। তা হলে পাকিস্তান বাহিনী এখনও শাসন করে যেত অখন্ড পাকিস্তানে। লেজেহোমো এরশাদ বসে থাকতো ক্ষমতার মসনদে। একসময় পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের পদলেহীরা বলতো পাকিস্তান বাঁচলে ইসলাম বাঁচবে। এখন আবার একই প্রতিধ্বনি শুনি। সামরিক বাহিনী আর দেশের অস্তিত্ব একাকার হয়ে গেছে। স্বৈরাচারের নখর দেখা যায়? ব্যয়বহুল নেইল ওয়ার্ক দিয়ে কি তা ঢাকা যায়? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছাত্র, সাংবাদিক আর সাধারণ জনতাকে যেভাবে অপদস্থ ও মিথ্যে বানোয়াট মামলায় জিম্মি করা হয়েছে তা কি পাকিস্তানী শাসকদের অপচ্ছায়া নয়? সত্য কি আর চাপা রাখা যায়? দেশের জনগণকে ঠেঙ্গিয়ে এখন বিদেশ বিভুঁইয়ে ভয় দেখানো শুরু হয়েছে? সামরিক সরকার ভয় কাকে পাচ্ছে? জনগণকে, না নিজের ছায়াকে?